রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিন


বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা আর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের মুখে রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্স প্রবাহের গতিপ্রকৃতির দিকে এখন সবার নজর। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয়ের আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি হলেও সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রপ্তানি আয়ের নিুমুখী প্রবণতায় সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রপ্তানি আয়ের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য রপ্তানির নতুন গন্তব্য সৃষ্টি কিংবা বিদ্যমান গন্তব্যগুলোকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া রপ্তানির ঝুড়িতে বিশ্ববাজারে প্রবেশে সক্ষম এমন পণ্যের সম্ভার বাড়াতে হবে।

যেমন রপ্তানি আয়ে একটি পণ্যের আধিপত্য প্রায় ৮১ শতাংশ (২০২১-২০২২)। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের রপ্তানি খাতের অন্যতম দুর্বলতা। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আমাদের রপ্তানি পণ্য পৌঁছেছিল ১০.৪১ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মোট রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ। একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের সর্ববৃহৎ আমদানিকারক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একক অঞ্চল যেখানে রপ্তানি হয়েছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪৪.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপীয় অঞ্চল বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৭০ শতাংশের গন্তব্যস্থল।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্যের ওপর ভারত সাফটার আওতায় ২০০৬ সাল থেকে শুল্ক সুবিধা প্রদান করলেও রপ্তানি সেই হারে বাড়েনি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১.৯৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে; যা ভারতের মোট আমদানির মাত্র ০.৩২ শতাংশ। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের অঘোষিত বিভিন্ন অশুল্ক বাধাকে এর জন্য দায়ী করা হলেও দেশের ব্যবসায়ীদের ভারতের বাজারের দিকে জোর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভারতীয় পণ্য আমদানির দিকে যত না ঝোঁক রয়েছে, বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানিতে তেমন উদ্যোগ নেই। বেশ কয়েক বছর আগে আমি কলকাতায় একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রতি ভারতীয় ক্রেতাদের প্রচুর আগ্রহ লক্ষ করলেও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পণ্য প্রদর্শনের বিষয়ে খুব একটা পেশাদার মনে হয়নি।

সরকারি উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্যমেলা আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের প্রায় ১.৩৯ বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ মধ্যবিত্ত, যাদের যথেষ্ট ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের তাদের পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য বিপণন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সেপা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি পণ্য আরও বেশি পরিমাণে ভারতে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা গ্রহণ না করলে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হবে না, বলা যায়।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা, সহজ কানেকটিভিটি, প্রায় একই সংস্কৃতির ভোক্তা শ্রেণির উপস্থিতি, ভারত কর্তৃক প্রদত্ত ট্যারিফ সুবিধা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যদি ভারতের এক-দশমাংশ জনসংখ্যার বাজার দখল করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হলে তাদের উৎপাদিত পণ্য ভারতের বাজারে শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারে।

৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের ওপর চীন শুল্ক সুবিধা প্রদান করলেও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চীনে মাত্র ০.৬৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা চীনের মোট আমদানির মাত্র ০.০৫ শতাংশ। চীন বছরে প্রায় ২.৭০ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। শূন্য শুল্ক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এ বাজারের ক্ষুদ্র একটি অংশও যদি দখল করা যায়, তাহলে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। চীনে আমাদের রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগ অংশজুড়ে আছে তৈরি পোশাক ও হোম টেক্সটাইল, মাছ আর চামড়া ও পাটজাত পণ্য। ১.৪১ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য পলিসিগত সুযোগ সৃষ্টি হলেও এ বাজারে প্রবেশের জন্য চীনের ক্রেতাদের চাহিদানুযায়ী পণ্য উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। চীনে বাংলাদেশের মূল রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা সৃষ্টি করতে হলে কার্যকর কৌশল এবং বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা ও চর্চা করা প্রয়োজন। সম্প্রতি এক জরিপ থেকে জানা যায়, চীনে উচ্চ আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা সাধারণত চেইন স্টোর থেকে ইউরোপীয় ও স্থানীয় প্রখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রয় করে থাকে। আর একটি শ্রেণি রয়েছে, যারা ফুটপাত কিংবা ছোটখাটো চেইন স্টোর থেকে স্বল্প দামের পোশাক ক্রয় করে থাকে। চীনে মজুরি ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্থানীয় উৎপাদকরা কমমূল্যের পোশাক তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আর তাই চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য চীনের ভোক্তাদের রুচি, ফ্যাশন, ডিজাইন, বাজারের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতাদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত গবেষণা করা প্রয়োজন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কর্তৃক দেশভিত্তিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সেল গঠন করে ব্যবসায়ীদের বাজার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও তথ্য প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

রপ্তানিকারকদের চীনের বাজারে স্বল্পমূল্যের পোশাকের সাপ্লাই চেইনে সংযুক্ত হওয়া, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ করা, নিজস্ব ডিজাইন সেন্টার তৈরি করা, চীনের ডিজাইনারদের বাংলাদেশে এনে প্রশিক্ষণ নেওয়া, চীনের ই-কমার্স প্ল্যাটফরমগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশি পোশাকের বিপণন করা, বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশি পণ্যের আন্তঃদেশীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফরম চালু করা, চীন যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে, সেসব পণ্য উৎপাদনের জন্য চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ দেওয়া গেলে চীনে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত হতে পারে। এজন্য সরকারকেই বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া চীন শুধু বাংলাদেশের আমদানির একটা বৃহৎ উৎস-এ ধারণাটি পালটে চীনকে বাংলাদেশের রপ্তানির অন্যতম গন্তব্যস্থান হিসাবে ভাবতে হবে।

ভারত ও চীনের পর আমেরিকা অঞ্চলের দেশ ব্রাজিল, মেক্সিকো ও চিলি, এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার প্রতিশ্রুতিশীল দেশগুলো, ইউরোপের রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব-এসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকান অঞ্চলের ব্রাজিল, মেক্সিকো ও চিলিতে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট ০.৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এ বাজারে আমাদের রপ্তানির প্রবৃদ্ধিহার বিবেচনায় নিলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তা কয়েক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে। এশিয়ার জাপানে একই সময়ে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ০.৫৩ বিলিয়ন ডলার এবং মালয়েশিয়ায় ০.৩৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এ দেশগুলোসহ এশিয়ার আরও কিছু দেশে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে এবং রাশিয়াসহ সিআইএসভুক্ত দেশগুলোয় রপ্তানি বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি খাতগুলো কর্তৃক প্রতিটি বাজারকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে রপ্তানি আয়ের সঙ্গে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যোগ হতে পারে।

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিয়েতনাম চীনে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের টেলিফোন, মোবাইল ফোন এক্সেসরিজ, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে এসব পণ্য উৎপাদন হয় না বললেই চলে। ভিয়েতনাম বিগত ২০ বছরে এ খাতে বিশ্বের রপ্তানিতে ৪৭তম স্থান থেকে ১০ম স্থানে উন্নীত হয়েছে এবং এর পটভূমি হিসাবে রয়েছে স্বল্পমজুরি, উৎসাহমূলক কর সুবিধা, বিশ্ববাজারের সমর্থন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পাদিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। স্যামসাং, এলজি ও ক্যাননের মতো বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড ভিয়েতনামে তাদের প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। এ ছাড়া ইন্টেল ভিয়েতনামে প্রসেসর ও ইলেকট্রনিক্স চিপস তৈরির প্লান্ট চালু করেছে। ভিয়েতনাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে ইলেক্ট্রনিক্স তৈরি করে আবার রপ্তানি করে থাকে। ভিয়েতনাম এখন বিশ্বের স্মার্টফোন উৎপাদনের একটি বড় হাব হিসাবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেরও উচিত এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সুবিধা দেওয়া। যেমন-১৫ বছরের জন্য কর সুবিধা, প্রশ্নবিহীন বিনিয়োগ সুবিধা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চীন-জাপান-ভারতসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিসম্পাদন এবং বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোকে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এ খাত দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বিশাল অবদান রাখতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বড় কিছু ইলেকট্রনিক্স জায়েন্ট শুধু বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বাজারের দিকে নজর দিয়ে এ খাতে এগিয়ে এলেও এ খাতটি যেন শুধু দেশের বাজারমুখী না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি রপ্তানিমুখী উদ্যোগগুলোকে সরকারের প্রণোদনামূলক নীতি কাঠামোর মাধ্যমে যেমন উৎসাহ দিতে হবে, তেমনি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা লুক্কায়িত কোনো বিড়ম্বনামূলক আইন যাতে উদ্যোগগুলোকে থমকে না দেয়, তার জন্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মকসুদুজ্জমান লস্কর : অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বাণিজ্য বিষয়ক লেখক

laskardhaka@yahoo.com

Author


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *